চুইঝালের চারা উৎপাদনে সাফল্য রূপসার আদর্শ কৃষক মহব্বত আলী
মোঃ আবদুর রহমান
রূপসী রূপসা খুলনা জেলার একটি কৃষি প্রধান উপজেলা। রূপসা নদীর নাম অনুসারে এ উপজেলার নামকরণ হয়েছে। রূপসা উপজেলার শতকরা ৮০ ভাগ লোকই কৃষির সাথে সম্পৃক্ত। এর আয়তন ১২০.১৫ বর্গকিমি. এবং আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৭০৫৮ হেক্টর। ফসলের নিবিড়তা ১৫৭%। ধান রূপসা উপজেলার প্রধান ফসল। এছাড়া বিভিন্ন প্রকার শাকসবজি, তরমুজ, বাঙ্গি, ডাল, তেল, মসলা ও ফল জাতীয় ফসল এ উপজেলায় চাষ হয়ে থাকে। রূপসা উপজেলার মাটি ও আবহাওয়া মসলাজাতীয় ফসল বিশেষ করে চুইঝাল চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী।
করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থাপনা শৃঙ্খলহীন হয়ে উঠতে পারে। দেখা দিতে পারে খাদ্য সংকট। আর সে প্রভাব বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশেও এসে পড়ার আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন পরিস্থিতি মাথায় রেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত দূরদর্শী ঘোষণা প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনার আলোকে রূপসা উপজেলার আলাইপুর গ্রামের আদর্শ কৃষক মহব্বত আলী শেখ এ বছর বসতবাড়ির আঙিনায় চুইঝালের চারা (কাটিং) উৎপাদন করে আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছেন। তার বাড়িতে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে পলিথিনের শেডের নিচে সারি সারি সাজানো পলিব্যাগে চুইঝালের সবুজ চারা।
মহব্বত আলী শেখ হতে জানা যায়, গত বছর মহামারি করোনা ভাইরাসের আতঙ্কে হতাশার জীবন নিয়ে বাড়িতে কর্মহীন সময় কাটছিল তার। কী করবেন তা ভেবে পাচ্ছিলেন না। শেষে উপজেলা কৃষি অফিস তার পথ খুলে দেয়। এ সময় তিনি কৃষি অফিস থেকে চুইঝাল চাষের ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর এর কাটিং থেকে চারা উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ হন। তারপর বাজার থেকে পেন্সিল ও আঙুলের মতো মোটা চুইঝালের লতা সংগ্রহ করে তা তেরছাভাবে কেটে এর কাটিং (দুই গিঁটসহ) বৈশাখ মাসের প্রথম দিকে পলিব্যাগে রোপণ করেন। ১৫ সেমি. লম্বা ও ১০ সেমি. প্রস্থ মাপের পলিব্যাগে অর্ধেক জৈবসার ও অর্ধেক ঝুরঝুরে উর্বর মাটি ভরে তাতে একটি করে কাটিং রোপণ করা হয়। কাটিং এর তেরছা অংশ (একটি গিঁটসহ) পলিব্যাগের মাটির নিচে রাখা হয়। আর মাটির ওপরের অংশে ১ বা ২টি গিঁট দেয়া হয়। কাটিং পলিব্যাগে রোপণের পর এর গোড়ার মাটি ভালোভাবে চেপে দিতে হয় যেন ভেতরে ফাঁকা না থাকে। তারপর হালকা পানি সেচ দিয়ে গোড়ার মাটি ভালোভাবে ভিজিয়ে দিয়ে থাকে। এছাড়া বর্ষা থেকে রক্ষার জন্য পলিথিনের শেড দিয়ে পলিব্যাগের চারা ঢেকে রাখা হয়। পলিব্যাগের মাটি বেশি শুকিয়ে গেলে মাঝে মাঝে ঝাঁঝরি দিয়ে হালকা সেচ দিতে হয়। পানি সেচের ফলে পলিব্যাগে যাতে পানি জমে যেতে না পারে সেজন্য পলিব্যাগের তলা থেকে ৩ সেমি. ওপরে চারদিকে বেশ কয়েকটি ছিদ্র করে দেয়া হয়।
কাটিং রোপণের ৩০-৪৫ দিন পর কুঁড়ি ও পাতা এবং ৫৫-৬০ দিন পর শিকড় গজায়। চারার পাতা পচা রোগ প্রতিকারের জন্য রিডোমিল গোল্ড এম জেড ৬৮ ডবিøউজি (প্রতি লিটার পানিতে ৫ গ্রাম) নামক ছত্রাকনাশক চুইঝালের চারার পাতায় নিয়মিত স্প্রে করা হয়। এভাবে তিনি পলিব্যাগে চুইঝালের চারাগুলোর পরম যতœ করেছেন। এতে কাটিং থেকে কুঁড়ি ও ধীরে ধীরে সবুজ পাতা বের হয়ে ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
বসতবাড়ির আঙিনায় মোট ৪ শতক জমিতে শেডের নিচে পলিব্যাগে তিনি প্রায় আড়াই হাজার চুইঝালের চারা উৎপাদন করেছেন। লতা ও পলিব্যাগ ক্রয়, জৈবসার ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে এতে প্রায় ১২ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। পলিব্যাগে কাটিং রোপণের দুই থেকে আড়াই মাস পর থেকে তিনি চুইঝালের চারা বিক্রি শুরু করেছেন। প্রতিটি চারা ৪০ টাকা হিসেবে এ পর্যন্ত সাড়ে চারশ’ চারা ১৮ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন এবং আরও প্রায় ২৮-৩০ হাজার টাকার চারা বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন। তিনি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, কাজদিয়া শাখা থেকে ৩০ হাজার টাকা পুঁজি হিসেবে ঋণ নিয়ে চারা উৎপাদন শুরু করেন। চুইঝালের চারায় ভালো দাম পাওয়ায় মহব্বত আলীর পরিবার অনেক খুশি। এ সাফল্য দেখে এলাকার অনেক কৃষক এর চারা উৎপাদনে উৎসাহিত হয়েছেন। তিনি এখন চুইঝালের চারা উৎপাদনের একজন সফল উদ্যোক্তা হয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে রূপসা উপজেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চুইঝালের চারা উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করতে কৃষি অফিস থেকে মহব্বত আলীকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ, প্রশিক্ষণ ও ব্যাংক খেকে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অধিকন্তু, চুইঝালের চারা সম্প্র্রসারণের লক্ষ্যে উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে মহব্বত আলীর কাছ থেকে কিছু চারা ক্রয় করে এ উপজেলার আগ্রহী কৃষকদের মাঝে তা বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে। উল্লেখ্য, চুইঝালের চারা উৎপাদন ও এর চাষ খুবই লাভজনক। এ ফসল চাষের জন্য খুব বেশি জমির প্রয়োজন হয় না। অল্প পুঁজি ও কম সময়ে অধিক লাভ হওয়ায় গত তিন বছর ধরে রূপসা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে চুইঝালের চাষ বেড়েছে।
চুই মসলাজাতীয় ফসল। এর কাÐ, শিকড় ও শাখা-প্রশাখা সবই মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর কাÐ বা লতা কেটে টুকরো টুকরো করে মাছ বা মাংস রান্নায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। রান্নার পর গলে যাওয়া সেসব টুকরো চুষে বা চিবিয়ে খাওয়া হয়। খুব ঝাল হলেও এর একটা অপূর্ব স্বাদ ও ঘ্রাণ আছে। বিভিন্ন সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানসহ ঈদ পার্বণে চুইঝালের কদর অনেকগুণ বেড়ে যায়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জেলা খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, নড়াইল এবং যশোর এলাকায় চুইঝাল মসলা হিসেবে খুব জনপ্রিয়।
চুইঝালে ০.৭ শতাংশ সুগন্ধি তেল রয়েছে। অ্যালকালয়েড ও পিপালারটিন আছে ৫ শতাংশ। তাছাড়া পরিমাণ মতো গøুকোজ, ফ্রুক্টোজ, গøাইকোসাইডস, সিজামিন ও পিপলাসটেরল রয়েছে। এর কাÐ, পাতা, শিকড়, ফুল ও ফল সবই ওষুধি গুণসম্পন্ন। চ্ইুঝাল গ্যাস্ট্রিক সমস্যা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। খাবারের রুচি বাড়াতে ও ক্ষুধামন্দা দূর করতে এটি কার্যকর ভ‚মিকা রাখে। পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহ দূর করতে এবং œায়ুবিক উত্তেজনা ও মানসিক অস্থিরতা প্রশমনে চুইঝাল বেশ উপকারী। এছাড়া শ্বাসকষ্ট, কফ, কাশি, ডায়রিয়া, শারীরিক দুর্বলতা ও গায়ের ব্যথা দূর করতে চুই ভালো কাজ করে।
চুইঝাল লতা জাতীয় অর্থকরী ফসল। এর কাÐ ধূসর এবং পাতা পান পাতার মতো সবুজ রঙের। চুইয়ের উদ্ভিদতাত্তি¡ক নাম চরঢ়বৎ ঈযধনধ। পরিবার পিপারেসি (চরঢ়বৎধপবধব)। চুই সাধারণত দুই প্রকার। একটির কাÐ বেশ মোটা ২০-২৫ সেমি., অন্যটির কাÐ চিকন, আকারে ২.৫-৫ সেমি. পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর গাছ ১০-১৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি এবং পানি নিষ্কাশনের সুবিধাযুক্ত ও ছায়াময় উচুঁ জমিতে সাধারণত চুই চাষ করা হয়। সাধারণ ফলবাগান বা বৃক্ষ বাগানের মাটি এফসল চাষের জন্য উপযোগী।
নার্সারিতে পলিব্যাগে কাটিং থেকে উৎপন্ন দুই মাস বয়সের চুইঝালের চারা বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ (এপ্রিল-মে) এবং আশ্বিন-কার্তিক (অক্টোবর-নভেম্বর) মাসে রোপণ করতে হবে। এজন্য আম, নারিকেল, সুপারি, মেহগনি এজাতীয় গাছের গোড়া থেকে ২৫-৩০ সেমি. দূরে ৪৫ সেমি. লম্বা, ৪৫ সেমি. চওড়া ও ৪৫ সেমি. গভীর করে গর্ত তৈরি করতে হয়। তারপর প্রতিটি গর্তের ওপরের স্তরের মাটির সাথে পচা গোবর বা আবর্জনা পচা সার ৫ কেজি, ১০০ গ্রাম টিএসপি ও ১২৫ গ্রাম এমওপি সার ভালোভাবে মিশিয়ে গর্তটি পুনরায় ভরাট করতে হবে। সার মেশানো মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট করে ৮-১০ দিন পর গর্তের ঠিক মাঝখানে চুইঝালের চারা (কাটিং) রোপণ করে চারপাশের মাটি হাত দিয়ে হালকাভাবে চেপে বসিয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনবোধে গোড়ায় আরও কিছু শুকনো মাটি দিয়ে চেপে বসিয়ে দিতে হবে। যাতে চারার চারপাশের মাটি জমির সমতল থেকে একটু উচুঁ ও ঢালু অবস্থায় থাকে। চুই রোপণের এক বছরের মধ্যে খাওয়ার উপযোগী হয়। তবে ভালো ফলনের জন্য ৫-৬ বছরের গাছ উত্তম। এ বয়সের একটি গাছ থেকে ১০-১৫ কেজি চুই পাওয়া যায়। একজন সাধারণ কৃষক মাত্র ২-৪টি চুই গাছের চাষ করে নিজের পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি চুই বাজারে বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব। চুই শিকড় থেকে কাÐ পর্যন্ত বিক্রি করা যায়। বাজারে প্রতি কেজি চুই বর্তমানে ৩০০ থেকে ১০০০ টাকা দরে বিক্রি হয়।
এখন চুই দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। চুইয়ের চাষ করে দারিদ্র্য বিমোচন, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব। তাই সম্ভাবনাময় অর্থকরী ফসল চুইঝাল চাষের ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া একান্ত প্রয়োজন। য়
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি অফিস, রূপসা, খুলনা। মোবাইল : ০১৯২৩-৫৮৭২৫৬, ইমেইল :rahman.rupsha@gmail.com